রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিয়ন পদে যোগ দিয়েছিলেন গোলাম কিবরিয়া, এখন তিনি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সারা দিন দায়িত্ব পালন করেন, সন্ধ্যায় বই-খাতা নিয়ে হাজির হন ক্লাসে। ঢাকার ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) এমবিএ পড়ুয়া কিবরিয়া ক্যাম্পাসের চেনা মুখ। এখন অনেকের অনুপ্রেরণা।
ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার প্রতি অসীম আগ্রহ ছিল গোলাম কিবরিয়ার। মেধার জোরও ছিল। মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার দর্শনা উচ্চবিদ্যালয়ের ‘ফার্স্ট বয়’ কিবরিয়া শিক্ষকদের স্নেহ পেয়েছেন। কিন্তু সংসারের হাল ধরতে গিয়ে এসএসসির পরই থামতে হয়েছিল। বাবা মারা গেলে মাকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় আসেন। অর্থ উপার্জনের জন্য কখনো চালিয়েছেন রিকশা, কখনো অটোরিকশা আবার কখনো ছাত্র পড়িয়েছেন।
তবে দারিদ্র্যের কারণে আগেও একবার ঢাকায় এসেছিলেন কিবরিয়া। ভাষানটেকে একটি দোকানের কর্মচারী ছিলেন। মাসখানেক পর ছুটিতে বাড়ি গেলে স্কুলশিক্ষক আর প্রতিবেশীদের জোরাজুরিতে কিবরিয়ার বাবা সৈয়দ আলী খলিফা ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন।
এভাবেই বইখাতার টানে পড়ার টেবিলে ফিরে এসে এসএসসি পাস করেন তিনি। ২০১১ সালে মাদারীপুরের সরকারি নাজিমউদ্দিন কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু কলেজ ছাড়তে হলো কিছুদিন যেতেই। আবেগতাড়িত হয়ে কিবরিয়া বলেন, ‘আব্বাও মারা গেলেন, আমাদের নিজেদের কোনো জমিজমাও নেই। আম্মার দেখাশোনার সব দায়িত্ব তখন তো আমার ইনকামের ওপরই। তাই আর পড়াশোনা করা হলো না, কলেজ ছেড়ে দিলাম।’
একটি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে দোকান থেকে বকেয়া অর্থ তোলার কাজ নিলেন। বেতন ছিল প্রায় ১০ হাজার টাকা। কিন্তু কিবরিয়া খুঁজছিলেন পড়াশোনার উপায়। শুধু পড়াশোনা করার সুযোগ পাবেন বলে চাকরি ছেড়ে অর্ধেক বেতনে ইউল্যাবে যোগ দেন। নতুন চাকরিতে কাজের সময় নির্দিষ্ট। সন্ধ্যায় পড়াশোনার জন্য যথেষ্ট সময় পেলেন। ভর্তি হলেন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে উচ্চমাধ্যমিকে।
সন্ধ্যায় নিজের পড়ার পাশাপাশি কয়েকজন ছাত্রকেও পড়ানো শুরু করলেন কিবরিয়া। এরপর থেকেই পড়াশোনায় নিয়মিত হয়ে গেলেন তিনি। কিবরিয়া বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ শুরু করার পর থেকে আমার পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। সিদ্ধান্ত নিই, যেভাবেই হোক পড়াশোনা চালিয়ে যাব।’
২০১৫ সালে এইচএসসি পাস করে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতক (পাস) কোর্সে ভর্তি হন। ২০১৯ সালে পাস করেন কিবরিয়া। এখন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশে (ইউল্যাব) এমবিএ দ্বিতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী তিনি।
অন্যদের অনুপ্রেরণা
সহকর্মীদেরও পড়াশোনার ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছেন কিবরিয়া। তাঁর উৎসাহে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের অন্তত ১১ জন পিয়ন আবারও পড়াশোনা শুরু করেছেন। কিবরিয়া জানান, এঁদের মধ্যে কেউ এখন উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছেন, কেউ আবার স্নাতকে ভর্তি হয়েছেন।
এদিকে কিবরিয়াকে উৎসাহ প্রদানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টি তাঁর এমবিএর সেমিস্টার ফির ওপর ৭০ শতাংশ ছাড় দিয়েছে। তবে সেমিস্টার ফির বাকি অর্থ জোগাড় করতেও কিবরিয়াকে বেশ বেগ পেতে হয়। খরচের কথা মাথায় রেখে প্রথম সেমিস্টারে কিবরিয়া একটিমাত্র কোর্স করেছেন। সবার মতো প্রতি সেমিস্টারে তিনটি কোর্সের টাকা জোগাড় করা অসম্ভব তাঁর জন্য। এক-দুটি করেই কোর্স নিতে চান তিনি। এমবিএ সম্পন্ন করতে অন্যদের চেয়ে হয়তো সময় কিছুটা বেশি লাগবে, কিন্তু তা নিয়ে কোনো আফসোস নেই তাঁর।
জাওয়াদুল আলম