বিসিএসে প্রথম স্থান অধিকারকারী ডা. নীলিমা ইয়াসমিন। তার জীবনের এক অসাধারণ গল্প, যা শুধু নারীদেরই নয়- আকৃষ্ট ও অনুপ্রাণিত করবে সবাইকে। অকুতোভয় লড়াই আর সীমাহীন পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে পথ পাড়ি দিয়েছেন ডা. নীলিমা। বাবা-মায়ের কাছে তিনি হয়েছেন একজন শ্রেষ্ঠ সন্তান। স্বামীর কাছে একজন যোগ্য স্ত্রী আর সন্তানের কাছে একজন আদর্শ মা।
ডা. নীলিমা ইয়াসমিনের জন্ম ফেনী জেলার দাগনভুঞা উপজেলার রামানন্দপুর গ্রামে। জন্ম সেখানে হলেও নীলিমা বড় হয়েছেন ঢাকায়। তার বাবা মো. হানিফ ছিলেন একজন আমেরিকা প্রবাসী। মা নিলুফা আক্তার গৃহিণী। চার বোনের মধ্যে তিনি মেজ। বড় বোন দুবাইয়ে থাকেন, সেজ বোন সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত রয়েছেন, ছোট বোন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছেন।
ডা. নীলিমা ইয়াসমিন ২০০৮ সালে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রব স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে মাধ্যমিক পাস করেন। ২০১০ সালে ভিকারুননিসা নুন কলেজ থেকে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক উভয় পরীক্ষায় তিনি বৃত্তি পেয়েছেন।
মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। কিন্তু বাবার ইচ্ছে ছিল মেয়ে ডাক্তার হবে তাই তিনি বেছে নেন চিকিৎসাশাস্ত্রকে। ভর্তি হন সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের ৪৯তম ব্যাচে। এমবিবিএস ৩য় বর্ষে থাকা অবস্থায় তার বিয়ে হয় ডা. মুহাম্মদ জিহাদুল হকের সঙ্গে। ডা. জিহাদুল একজন এনেস্থেসিয়া, এনালজেসিয়া ও ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। তিনি নোয়াখালীতে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে কর্মরত রয়েছেন।
২০১৬ সালে ডা. নীলিমা ৮৬.৫ ভাগ নম্বর পেয়ে এমবিবিএস পাস করেন। সর্বোচ্চ সংখ্যক নম্বর পাওয়ায় সম্মানস্বরূপ প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক-২০১৭ পান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেন। ইন্টার্নশিপ করার মাঝামাঝি সময় তার কোলজুড়ে আসে একমাত্র সন্তান নাহিয়ান হক। সন্তান জন্মের এগারো দিন পরেই আবার যোগদান করেন ইন্টার্নশিপে। সন্তানকে দেখাশোনার পাশাপাশি ভর্তি হন এফআরসিএস (গাইনোকোলজি) কোর্সে, একই সঙ্গে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতিও নেন। এফআরসিএস ফাইনাল পরীক্ষার দু-তিনদিন আগে ৩৮তম বিসিএসের পরীক্ষা দেন। এফআরসিএস পার্ট-১ সম্পন্ন করেই ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজে ফেলোশিপ ট্রেনিং-এ। এক বছরের কোর্স শেষ করে ভর্তি হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট রেসিডেন্সিতে। এখানেও তিনি ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। বর্তমানে তিনি অধ্যয়নরত রয়েছেন লন্ডন রয়েল কলেজ অব অবস্ট্রাক্ট অ্যান্ড গাইনোকোলজিতে। শিগগিরই মেম্বার অব কলেজ অব অবস্ট্রাক্ট অ্যান্ড গাইনোকোলজি পার্ট-১ কোর্সের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবেন। এর মধ্যেই তিনি ৩৮তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বিসিএসে প্রথম স্থান অধিকার করেন।
এ প্রসঙ্গে ডা. নীলিমা ইয়াসমিন বলেন, সবাই আমাকে সাধারণ ক্যাডারে যাওয়ার পরামর্শ দিলেও আমি চিকিৎসা পেশায় থাকতে ইচ্ছুক। এ পেশায় থেকেই মানুষের জন্য ভালো কিছু করতে চাই। আমার এ সফলতার পেছনে সবচেয়ে যে মানুষটির অবদান রয়েছে, তিনি আমার স্বামী ডা. মুহাম্মদ জিহাদুল হক। আমাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছেন। এখানে আমার মা এবং শ্বশুর-শাশুড়ির কথা না বললেও নয়। তাদের সহযোগিতা না পেলে আমার এ অর্জন সম্ভব হতো না।
লেখাপড়ার পাশাপাশি রান্না করা ডা. নীলিমার বড় একটা শখ। এত কিছুর পরেও তিনি রান্না করেন। সময়-সুযোগ পেলে ঘুরে বেড়ান। বিশেষ করে সাগরে ঘুরতে তার বেশি ভালো লাগে। আর সময় পেলেই পাঠ্যবইয়ের বাইরেও বিভিন্ন ধরনের বই পড়েন তিনি।
ডা. নীলিমা ইয়াসমিন মনে করেন, তার জীবনের ৯০ ভাগ হচ্ছে তার রোগীদের জন্য আর বাকিটুকু অন্য সবকিছুর জন্যে। একজন ডাক্তারের মিষ্টব্যবহারই একজন রোগীর জন্য বড় চিকিৎসা। কিন্তু আমাদের দেশে ডাক্তারের তুলনায় রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় ডাক্তাররা সেটি করে উঠতে সক্ষম হয় না। ঠিকভাবে সময় দিতে পারেন না তারা। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে আরও বেশি বাজেট দরকার। মেডিকেল কলেজ সংখ্যায় নয় মান বাড়াতে হবে।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শুধু মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করলেই হবে না। দুইটা ক্লাসরুম দিয়েই একটি মেডিকেল কলেজ হতে পারে না। একটি মেডিকেল কলেজের অবশ্যই হাসপাতাল থাকতে হবে। যাতে ডাক্তাররা নিয়মিত অনুশীলন করতে পারেন। হাসপাতালের পরিবেশ, অপারেশন থিয়েটারের পরিবেশ সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। হাসপাতালে যন্ত্রপাতি ও ওষুধের প্রাচুর্যতা বাড়াতে হবে। সব বিষয়ে ডাক্তারদের দোষারোপ করা বন্ধ করতে হবে। কারণ চিকিৎসা সেবার প্রশাসনিক বিষয় ডাক্তারদের হাতে নেই। আর অসৎ ডাক্তারদের সংখ্যাও খুব বেশি নয়। তাই চাইলেই চিকিৎসা ক্ষেত্রে উন্নতি করা সম্ভব।
একজন গাইনি ডাক্তার হিসেবে তিনি বলেন, অপ্রয়োজনীয় সিজার বন্ধে সবার কাজ করা উচিত। মাতৃত্বকালীন পুষ্টি ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে মেয়েদের সচেতন করা উচিত। সঠিক কারণ ছাড়া যাতে কারো সিজার না করা হয় এ বিষয়ে কঠিন ব্যবস্থা নেয়া দরকার। এছাড়া সব ডাক্তারদের উচিত রোগীর সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক তৈরি করা। এ পেশায় থেকে তারা যেন কোনো ধরনের অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত না হন- এটাই আমার প্রত্যাশা।
ডা. নীলিমা ইয়াসমিন স্বপ্ন দেখেন নিজের পেশায় একদিন সেরা হয়ে উঠবেন। দেশ ও জাতির কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করবেন। রোগীদের মুখের হাসির কারণ হয়ে উঠবেন। তিনি নিজেই একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে চান যেখানে প্রসুতিদের ব্যথামুক্ত প্রসব করান হবে। মাতৃত্বকালীন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করবেন। সেখানে গরিব মানুষের জন্য থাকবে বিশেষ ব্যবস্থা।
মাহবুব নাহিদ